ঘুষ, আত্মসাৎ

Posted Posted by আরিফ in Comments 0 comments

আব্দুস সালাম সুনামগঞ্জী

আল্লাহপাক মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ট জাতি করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও কথাবলার শক্তি দান করেছেন। মানুষ সামাজিক জীব, তাই সমাজবদ্ধভাবে শান্তিতে বসবাস করার জন্য ইহকাল ও পরকাল সুখের হওয়ার জন্য জীবন বিধান স্বরূপ কুরআন দান করেছেন। যারা কুরআনের বিধান মত জীবন পরিচালনা করে তারা প্রকৃত মানুষ। আর যারা কুরআনের বিধান তথা শরীয়তকে মানে না তারা প্রকৃত মানুষ নয়। তারা শান্ত সমাজকে অশান্ত করে, ফিৎনা-ফাসাদ, ঘুষ, আত্মসাৎ, ছিনতাই, চুরি, অত্যাচার দ্বারা মানুষকে বিভিন্ন প্রকারে কষ্ট দিতে থাকে। যা অবৈধ ও হারাম।
আল্লাহপাক তাঁর পবিত্র কালামে ইরশাদ করেন, তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের ধন সম্পদ আত্মসাত করোনা এবং অপরের ধনসম্পদ গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা শাসকদের নিকট পৌঁছাইওনা আর তা তোমরা খুব ভালভাবেই জান। (সূরা বাকারা-১৮৮)
আল্লামা সানাউল্লাহ পানিপতি (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন "এবং তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করোনা অর্থাৎ যেমন কারও সম্পদের উপর মিথ্যা দাবী করা অথবা মিথ্যা স্ব্যা দেওয়া, কারো সত্য দাবীকে অস্বীকার করে তার উপর মিথ্যা শপথ করা অথবা কারো প্রাপ্য অধিকার (ঘুষ গ্রহণ করে) অন্যকে দিয়ে দেওয়া। দূর্নীতি করা, লণ্ঠন করা, চুরি করা, খেয়ানত করা, জুয়ার মাধ্যমে অর্থ সম্পদ রোজগার করা, গান বাজনার বিনিময় গ্রহণ করা। গনকের রোজগার, ঘুষ প্রভৃতি পন্থাকেই কুরআনে বাতিল পন্থা বলে আখ্যায়িত করেছে।

ঘুষ:
কোন বিচারক কিংবা দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে নিজের পে বিচার করার জন্য কিংবা উদ্দেশ্য সাধনের ব্যাপারে নিজেকে অন্যায়ভাবে সহযোগিতা করার জন্য যে মাল-সম্পদ কিংবা সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়, শরীয়তের পরিভাষায় তাকেই রিশওয়াত বা ঘুষ বলা হয়।
ঘুষ সকল দূর্নীতির মূল। তাই হাদীসে বর্ণিত আছে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মুকাদ্দমায় ঘুষগ্রহীতা ও ঘুষদাতা উভয়ের প্রতি অভিশম্পাত করেছেন। (তিরমিযী ১৩৪১ নং হাদীস) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ যা ঘুষদাতা ও গ্রহীতার প্রতি অভিসম্পাত করেছেন। (তিরমিযী ১৩৪২নং হাদীস) আহমদ এবং বায়হাকী (রহ.) শোয়াবুল ঈমানে সাওবান হতে বর্ণনা করেছেন। তাতে অতিরিক্ত আছে ঘুষদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারীর উপর ও অভিসম্পাত করেছেন। (মিশকাত শরীফ) রাসূল সা. আরো ইরশাদ করেছেন ঘুষ গ্রহণকারী ও ঘুষদাতা উভয়েই দোজখে প্রবেশ করবে। (তাফসীরে নূরুল কুরআন) হযরত আবু উমামা রা. হতে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোন শাসক বা বিচারকের নিকট সুপারিশ নিয়ে যায় পরে তার নিকট হাদিয়া বা উপঢৌকন প্রেরণ করে। আর শাসক বা বিচারক সে হাদিয়া গ্রহণ করে তবে সে সুদের দরজাগুলোর মধ্যে একটি বড় দরজায় প্রবেশ করে। (আবু দাউদ)
আমাদের সমাজে ঘুষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অথচ যে সমাজে তা চালু হয়, সে সমাজে প্রশাসনের মেরুদন্ড ভেঙ্গেঁ পড়ে, ন্যায় অন্যায়ের কোন পার্থক্য থাকেনা, নিয়ম-নীতির কোন বালাই থাকেনা। দুর্নীতি হুঁ হুঁ করে বাড়তে থাকে, মানুষের জান মালের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। অন্যায় ও জুলুমের প্রতিকার করার প্রবণতা সেই সমাজ থেকে ক্রমান্নয়ে লোভ পায়। অপরাধী বুক ফুলিয়ে চলে, আর নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষ চরম অসহায়ত্বের মাঝে ধুকে ধুকে মৃত্যুর প্রহর গুণে। নির্যাতিত মানুষ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ইনসাফ পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা বোধ করেনা। এ কারণেই ইসলাম এমন জঘন্য পন্থায় মাল উপার্জনকে নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করেছে। যাতে অন্যায় ও অবিচার থেকে জাতি রা পেতে পারে এবং ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক শান্তির সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
রাষ্ট্রীয় কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতির প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য ইসলাম শুধুমাত্র ঘুষ নিষিদ্ধ করেছে তাই নয়। বরং পদের প্রভাব খাটিয়ে কোন কর্মচারী বা কর্মকর্তা কিছু উপার্জন করলে কিংবা কোন কর্মকর্তার পদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তার আত্মীয়-স্বজনরা কোন অর্থনৈতিক কিংবা অন্য কোন সুযোগ সুবিধা আদায় করলে সেটাকেও নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কেননা এ ধরণের পথ খোলা থাকলে এটা সুষ্টু ও ন্যায়ানুগ কার্যক্রম পরিচালনার েেত্র মানসিকভাবে বাধা সৃষ্টি করে।
হযরত উমর রা. যখন কাউকে কর্মকর্তা নিয়োগ করতেন। তখন তার ব্যক্তিগত মালামালের পরিমাণ হিসাব করে রাখতেন। যাতে কর্মকর্তারা তাদের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ উপার্জন করতে না পারে। (আল ইকতিসাদুল ইসলামী)

আত্মসাত:
আত্মসাত করা মহাপাপ। হযরত মুয়ায রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেছেন, নবী করীম (সা.) আমাকে ইয়ামান প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠালেন। আমি রওয়ানা হয়ে যাবার পরে তিনি আমাকে ডেকে আনার জন্য আমার পেছনে এক ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দিলেন। আমি তাঁর নিকট ফিরে এলে তিনি বললেন, আমি তোমাকে কি জন্য আবার ডেকে আনলাম তা বলতে পার কি? আমি তোমাকে এ কথা বলার জন্য ডেকে এনেছি যে, আমার অনুমতি ব্যতীত কোন সম্পদই ভোগ করবে না। কেননা তা খিয়ানাত বা আত্মসাৎ ব্যতীত কিছু নয়। আর যে ব্যক্তি যে বস্তু আত্মসাৎ করবে কিয়ামত দিবসে সে সে বস্তু কাঁধে বহন করেই হাশরের মাঠে উপস্থিত হবে। একথা বলার জন্যই আমি তোমাকে ডেকে এনেছি। এখন তুমি তোমার কার্যস্থলে চলে যাও। (তিরমিযী, মিশকাত শরীফ ৩৫৭৯নং হাদীস)
হযরত খাওলাতুন আনসারিয়া (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, কিছু লোক আল্লাহর সম্পদে তথা বাইতুলমালের সম্পদ বা গনিমতের মালে অন্যায়ভাবে ব্যয় করে থাকে। এ শ্রেণীর লোকদের জন্য কিয়ামত দিবসে নির্ধারিত রয়েছে দোযখের শাস্তি। (বুখারী) হযরত বুরাইদা রা. হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, যে লোককে আমরা কোন কাজে নিযুক্ত করি এবং তাকে সে কাজের বিনিময়ে মজুরী প্রদান করি, যদি সে তারপর ঐ মজুরীর অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করে, তবে তা হবে খিয়ানত স্বরূপ বা আত্মসাত। (আবু দাউদ) সুতরাং, আমরা সর্বপ্রকার খিয়ানত, ঘুষ ও আত্মসাত থেকে বিরত থাকি। সর্বপ্রকার দুর্নীতি থেকে জাতিকে রা করি।

লেখক: গ্রন্থকার
জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজিরবাজার, সিলেট


0 comments:

Post a Comment